Labels

Recent News of WikiBangla ধূমকেতু নিউজ ম্যাগাজিন

এই চেতনা অমর হোক- লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত

বাংলাদেশের ৪৩তম স্বাধীনতাবার্ষিকীতে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রায় তিন লাখ মানুষের সমবেত হয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, এতে দেশবাসীর আবেগময় অনুভূতিরও প্রকাশ ঘটেছে। ছাত্র-তরুণ-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাবেশস্থলটি হয়ে উঠেছিল নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রতীক।
সবার হাতে ছিল বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আর মুখে সেই জাতীয় সংগীতের অমর সুরলহরি। তাই মহতী এই আয়োজনের উদ্যোক্তা, বিশেষ করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে আমরা অভিনন্দন জানাই। সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার এই ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থানকে আরও অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছে। এর মাধ্যমে লাখো প্রাণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের প্রতি দেশবাসীর গভীর আবেগ ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে। মূর্ত হয়ে উঠেছে আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি তথা জাতীয় সংগীতের প্রতি আমাদের গাঢ় শ্রদ্ধাবোধ। উল্লেখ্য, কেবল জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডেই নয়, দেশের সর্বত্র, যে যেখানে ছিলেন, সেখান থেকেই জাতীয় সংগীত গেয়ে তাঁরা নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান যে সংগীত, তার প্রমাণ আমরা পাই ইতিহাসের পরতে পরতে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ক্ষুদিরামেরা গান গাইতে গাইতে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেছেন। ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীতের প্রচারণা নিষিদ্ধ করলে রাজপথে গান গেয়েই এ দেশের শিল্পী, কবিসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ সেই অন্যায় আদেশ রুখে দিয়েছেন।
স্বাধীনতা দিবসে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আমাদের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে মেলবন্ধন তৈরি হলো, তাকে আরও এগিয়ে নিতে হবে প্রতিদিনের চিন্তা-কর্মে ও দেশপ্রেমের অবিচল প্রত্যয়ে। আনুষ্ঠানিকতার বৃত্ত থেকে বের হয়ে এই কালজয়ী সংগীতের মর্মবাণীকে ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি যে আমাদের গভীর ভালোবাসা আছে, প্রতিটি দিবসে ও ক্ষণে আমরা তা নিজেরা যেমন তার বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট থাকব, তেমনি অন্যদেরও করব উজ্জীবিত। এই গানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করে তার অঘ্রানের ভরা খেত দেখে যেমন মুখে হাসি ফোটানোর কথা বলেছেন, তেমনি তার বদনখানি মলিন হলে নয়ন জলে ভাসার বেদনাও প্রকাশ করেছেন।
জাতীয় সংগীতের মর্মবাণী হূদয়ে ধারণ করে মা-রূপ দেশের মুখে যেন সর্বদা হাসি ফুটে থাকে, যেন কখনো তার মুখ মলিন না হয়, সেই লক্ষ্যেই আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। দেশের স্বার্থকে দল ও মতের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। বিভেদ ও বৈরিতার বদলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে, সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা ছিল একাত্তরের প্রত্যয়।

নির্বাচন কমিশনকে জবাবদিহি করতে হবে- পুরোনো নির্বাচনী সংস্কৃতি

যেমন আশঙ্কা করা হয়েছিল, তেমনটিই হয়েছে উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ দফায়। প্রথম দফা নির্বাচনের তুলনায় সংঘাত-সহিংসতা, কারচুপির অভিযোগ ও ভোটকেন্দ্র দখল—সবই ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে পরবর্তী প্রতি দফায়। চতুর্থ দফায় তো তা রীতিমতো ‘কেন্দ্র দখলের’ নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের যে ধারা বাংলাদেশে সূচনা হয়েছিল, তা সম্ভবত এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আরও মুমূর্ষু হয়ে পড়ল।

চতুর্থ দফার নির্বাচনে ভোট হয়েছে ৯১টি উপজেলায়। এর মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪০টি উপজেলায়। মারা গেছেন চারজন। সিল মেরে ভোটের বাক্স ভরা, নির্বাচনী সরঞ্জাম ছিনতাই ও আগুন দেওয়া, এজেন্টদের বের করে দেওয়া, ভোটকেন্দ্র দখল—যে বিষয়গুলো আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি থেকে বিদায় নিয়েছে বলে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছিলাম, তার সবকিছুরই পুনরাবির্ভাব ঘটল চতুর্থ দফা নির্বাচনে। এবারের উপজেলা নির্বাচনের এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি (?)! এর কৃতিত্ব (?) নির্বাচন কমিশনকে দিতেই হচ্ছে!
কোনো ধরনের নির্বাচনী সহিংসতা, প্রাণহানি, ভোটকেন্দ্র দখল বা কারচুপির অভিযোগ ছাড়াই অসংখ্য নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দেশে রয়েছে। গত নির্বাচন কমিশন এর সূচনা করে নির্বাচনী সংস্কৃতিতে এই মৌলিক পরিবর্তনটি আনতে সক্ষম হয়েছিল। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও শুরুতে তা বজায় রাখতে পেরেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এ ধরনের নির্বাচন সম্ভব হলে বর্তমানে তা সম্ভব হচ্ছে না কেন? এই সময়কালে নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক ধরনের সরকার যেমন ক্ষমতায় ছিল, তেমনি দলীয় সরকারও ক্ষমতায় ছিল। এখন পরিস্থিতি পাল্টাল কেন?
বাংলাদেশে নির্বাচনে পুরোনো সংস্কৃতি ফিরে আসার দায় প্রথমত নির্বাচন কমিশনের। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা আগের চেয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে বলে দাবি করেছেন। তাঁর এই দাবির সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। ভোট যদি শান্তিপূর্ণই হবে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটল কেন? এ রকম ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোট কারোরই কাম্য নয়। নির্বাচনের সময় প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে বাধ্য। তারা যদি প্রশাসনকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজে ব্যবহার করতে না পারে, সেটা তাদেরই ব্যর্থতা।
এটা ঠিক যে এবারের উপজেলা নির্বাচনে সরকারি দল ও তাদের সমর্থকদের শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিন্তু আমরা মনে করি যে একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন দৃঢ় অবস্থান নিতে পারলে সরকার বা সরকারি দল বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে না। নির্বাচনে কেন সহিংসতা ও কারচুপি ফিরে আসছে, কেন আগাম আশঙ্কা সত্ত্বেও এসব ঠেকানো যাচ্ছে না, তার ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে। যদি সরকারের অসহযোগিতার কারণে তা হয়ে থাকে, তবে সেটাও নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট করে বলতে হবে। এটা না করতে পারলে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ বর্তমানে যে মুমূর্ষু দশার মধ্যে রয়েছে, সেটিকে আর বাঁচানো যাবে না।

আমরাই মুক্তিযুদ্ধ করেছি গুন্ডেরা নহে by মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক

কলাম লিখতে গিয়ে প্রিয় ও অপ্রিয় অনেক বিষয়ই চলে আসে। এই কলামের বিষয়টা অনেকের কাছে অপ্রিয় কিন্তু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের হৃদয়ের কাছে একটি প্রিয় বিষয় এবং মনের আকুতি। বিষয়টি হচ্ছে- অতি সমপ্রতি বাজারে আসা একটি হিন্দি সিনেমা।

সামপ্রতিক বলিউডি ছবি ‘গুণ্ডে’তে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। ছবির শুরুতে নেপথ্য কণ্ঠে বলা হয়েছে- ‘১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১, শেষ হলো ভারত-পাকিস্তানের তৃতীয় যুদ্ধ। প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি ফৌজ আত্মসমর্পণ করলো ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে সেদিন। এটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণ। এই যুদ্ধের ফলে জন্ম নিলো একটি নতুন দেশ, বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের প্রতিটি সচেতন মানুষই পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, তাঁরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এর প্রতিফলন দেখা গিয়েছে।
কেউ কেউ বলেছেন, ছবিটি যেহেতু ভারতীয় সেন্সর বোর্ড হয়ে এসেছে, বোর্ড মেম্বাররাই ছবিটির সেন্সর ছাড়পত্র দিয়েছেন এবং তারা যেহেতু সরকারেরই নিযুক্ত, সুতরাং ভারত সরকার সচেতনভাবেই কাজটি করেছে। তবে আমি মনে করি না যে, ভারত সরকার সচেতনভাবে এই কাজটি করেছে। আমি মনে করি ভারতের জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশের মনের অবচেতন অংশে এইরূপ ধারণা বিদ্যমান এবং সেই ধারণাটাই এই সিনেমার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। গুণ্ডে ছবির সমালোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সরকারেরও সমালোচনা হচ্ছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হয়েছে দেখার পরও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত যথেষ্ট প্রতিবাদ জানানো হয়নি।
আমাদের চলচ্চিত্র জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব গাজী মাজহারুল আনোয়ার অনেকটা এ রকম বলেছেন, ‘আমরা স্বীকার করি স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত আমাদেরকে সহায়তা করেছে। স্বাধীনতা, বাংলাদেশের লাখ লাখ সংগ্রামী মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমাদের অর্জন। কারও দয়ায় নয়। ‘গুণ্ডে’ ছবিতে বলা হয়েছে, ভারত, যুদ্ধে পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। আমি তাদের এই মনোভাবে বিস্ময় প্রকাশ করে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন কলমসৈনিক হিসেবে আমার রক্ত, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, আর ৩ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের কি কোন মূল্য নেই?’ আমাদের চলচ্চিত্র জগতের আরেকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব চাষী নজরুল ইসলাম অনেকটা এ রকম বলেছেন, ‘গুণ্ডে ছবির উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি আঘাত।’ বিখ্যাত সংগীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী যা বলেছেন তার মধ্যে অন্যতম একটি বক্তব্য হচ্ছে- ‘এই ছবির প্রতি আমার ঘৃণা জন্মেছে। মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের চলচ্চিত্রের মতো একটি বড় ক্যানভাস থেকে এমন মেসেজ সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক এবং এলার্মিং।’ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি এই কলামে কিছু কথা তুলে ধরতে চাই এবং গুণ্ডে ছবিতে প্রকাশিত মনোভাবের কারণে এই কথাগুলো অতিরিক্ত তাৎপর্য বহন করে বলে আমি মনে করি। আমার কথাগুলো নতুন নয়।
মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য বিভিন্ন বয়সী ও বিভিন্ন পেশাজীবীর নিকট কম-বেশি ভিন্নভাবে প্রতিফলিত বা উদ্ভাসিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। বর্তমান বাংলাদেশের জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র ১৯৭১ সালের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা তথা মুক্তিযুদ্ধ ও ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১-এর সাক্ষী। বয়সের ভারে এবং অন্যান্য সাংসারিক চাপে তারা অনেকেই ক্লান্ত। তাদের কাছে বিজয় দিবসের তাৎপর্য এবং ’৭১ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ওই দিবসটির তাৎপর্য কম-বেশি ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। প্রতি বছর যখন মার্চ বা ডিসেম্বর আসে তখন আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম এবং যুদ্ধের মাধ্যমে একটি আক্রমণকারী বা হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। আমরা কিছু অনুভূতি ও চেতনাকে অন্য কিছু অনুভূতি ও চেতনার উপর অধিকতর মূল্য দিয়ে স্থাপন করেছিলাম। বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে দেশ পরিচালনা শুরু করেছিলাম ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সন্ধ্যা থেকে। মরুভূমিতে রাত্রে পথ চলার সময় পথিক যেমন বারবার আকাশের উত্তরাংশে উজ্জ্বলভাবে স্থিত ধ্রুবতারার দিকে তাকায় নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে, তার গন্তব্যের দিক ঠিক আছে কিনা, অথবা আধুনিক যুগে সৈনিক বা নাবিক কম্পাস এর কাঁটা মিলিয়ে দেখে গন্তব্যের দিক ঠিক আছে কিনা, তেমনই রাজনৈতিকভাবে আমরা প্রতি বছরের ১৬ই ডিসেম্বর এলে অন্তত একবার হিসাব মিলানোর সুযোগ পাই। কিসের উপর বিজয় অর্জন করেছিলাম, অর্জনটুকু ঠিক আছে না ক্ষয়ে গিয়েছে এবং পথভ্রষ্ট বা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে থাকলে কি করা যেতে পারে? তবে এই ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে তথা মার্চ এর আগমনের মুহূর্তে এই তাৎপর্য আর কি অতিরিক্ত গুরুত্ব পায় এবং কেনই বা অতিরিক্ত গুরুত্ব পায় সেটা অতি সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরতে চাই।
দর্শনীয়ভাবে (ইংরেজি ভাষায় ভিজিবলি) পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও তাদের সহযোগিতাকারীদের ওপর বিজয় অর্জন করেছিল মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড। দর্শনীয়ভাবে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের উপর বিজয় অর্জন করেছিল ভারত ও বাংলাদেশ নামক দু’টি রাষ্ট্র। দার্শনিক বা তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে: (এক) পাকিস্তানি সামরিক শাসন তথা স্বৈরশাসনের ওপর বিজয় অর্জন করেছিল তৎকালীন পূর্ব- পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের শক্তি ও ইচ্ছা। (দুই) পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ বাধ্য করছিল বাঙালিদেরকে পাকিস্তানে থাকতে। ওই প্রক্রিয়াকে অস্বীকার (ইংরেজি ভাষায় ডিনাই) করত স্বাধীন ও সার্বভৌম হওয়ার অধিকার আদায় হয়েছিল। (তিন) পাকিস্তানি অগণতান্ত্রিক অভ্যাস ও রেওয়াজের বিপরীতে বিজয় অর্জন করেছিল গণতান্ত্রিক অভ্যাস ও চিন্তা-চেতনা। (চার) পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে পূর্বপাকিস্তানি বাঙালি জনগোষ্ঠী কর্তৃক পরিচালিত প্রতিবাদের বিজয় হয়। (পাঁচ) পাকিস্তানি সরকার ও শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক, শান্তি ও সাম্যের মহান ধর্ম ইসলামের নাম ব্যবহার করে জনগণের ওপর বর্বরতা  বাস্তবায়ন ও অসাম্যের ধারা বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জয় হয় তথা মানবিকতা বা মানবতাবাদের জয় হয়।
তবে, আলোচনা করতে গেলে অনেকগুলো শিরোনাম আলোচকের সামনে উপস্থিত হয়। স্থানাভাবে এই সংক্ষিপ্ত কলামে সবকিছু আলোচনা করা যাবে না এবং সবকিছু আলোচনা করতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ একটি বা দু’টি বিষয়ের উপর থেকে ‘ফোকাস’ হারিয়ে যেতে বাধ্য। তাই আমি বিরাজমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য থেকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিস্থিতিটিকে আলোচনায় সামনে আনছি।
দীর্ঘ প্রায় ২২-২৩ বছরের বিভিন্ন মাত্রার ও আঙ্গিকের সংগ্রামের সর্বশেষ ধাপ হলো ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ। সূক্ষ্ম হিসাবে ২৬৬ দিন। যাহোক আমরা ১৯৭১-এর আলোচনায় আসি। ২৫শে মার্চ ১৯৭১ দিবাগত রাত্রে ১২টা বা ১২টার পর তথা ২৬শে মার্চ প্রত্যক্ষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে ভারতের সাহায্য সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। অক্টোবর মাসে প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশী সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে একটা গোপন চুক্তি হয়। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে পরোক্ষ সহযোগিতার মাত্রা চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ থেকে ভারত ও পাকিস্তান প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর অপরাহ্ন ৪টা পর্যন্ত তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মাটিতে ভারতীয় সামরিক বাহিনী ও পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাগণ যথা ‘জেড’ ফোর্স, ‘এস’ ফোর্স, ‘কে’ ফোর্স এবং বিভিন্ন সেক্টর-এর সেক্টর ট্রুপসগণ, যেমন যুদ্ধ চালাচ্ছিলেন তেমনই চালাতে থাকলেন তবে ৩রা ডিসেম্বর থেকে সেটা চালানো হলো ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধের সাংগঠনিক কাঠামোর (ইংরেজিতে সামরিক পরিভাষায়: অর্ডার অব ব্যাটল (ইংরেজি ভাষায় অরব্যাট) সঙ্গে তাল মিলিয়ে, যৌথ কমান্ডের অধীনে, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাগণ যারা সারা বাংলাদেশে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে ছড়িয়ে থেকে যুদ্ধরত ছিলেন তারা, বিগত মাসগুলোর মতো প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক গেরিলা তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। সার্বিকভাবে ভারতীয় ও মুক্তি বাহিনীর আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডের ফলস্বরূপ ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের রেকর্ড এবং ছবি অনুযায়ী, পাকিস্তানিদের পক্ষে আত্মসমর্পণ করেন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড-এর কমান্ডার লে. জেনারেল এএকে নিয়াজী এবং আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড এর কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। সেই অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি তৎকালীন কর্নেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না (বা তাঁকে উপস্থিত রাখা হয়নি!!)। প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর কোন প্রতিনিধিকেও আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট করা হয়নি। অর্থাৎ জিনিসটা এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যে, ১৩ দিনের দীর্ঘ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছে এবং ওই যুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানিগণ ওই যুদ্ধের বিজয়ী ভারতীয়দের নিকট আত্মসমর্পণ করছে। ইংরেজিতে দু’টি শব্দ আছে যথা মার্জিন বা মার্জিনালাইজড। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে অপরাহ্নে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সফলভাবেই মুক্তিবাহিনীর অবদান ও সাফল্যকে মার্জিনালাইজড করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় ও বিজয়ের আনন্দ ওই বিকালবেলায় ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল। দুই বছর পর সিমলায় অনুষ্ঠিত আলোচনার পর যেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেই চুক্তির ফলেও বাংলাদেশের মানুষের এবং মুক্তিযোদ্ধাগণের অবদানকে মার্জিনালাইজড করে ফেলা হয়। এতদ্‌সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাগণ এবং মুক্তিযোদ্ধাগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সচেতন জনগণ নিজেদের প্রেরণায়, নিজেদের আত্মসম্মানের তাগাদায় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসকে একান্তই নিজেদের বিজয় হিসেবে সমুন্নত রেখেছে সফলভাবে। ওই বিজয়টি বাস্তবে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের এবং ওই আমলের বাংলাদেশের জনগণের। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ১৯৭১-এর বিজয়টি প্রেরণার একটি অম্লান চিরন্তন উৎস। এই উৎসকে অক্ষত রাখা অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৭১-এর রণাঙ্গনে রক্ত বিনিময়ের মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশ নামক দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে এবং দু’টি রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে যেই সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল সেই সম্পর্কটির উষ্ণতা বিগত ৪২ বছর সময়কালে একই রকম থাকেনি। বিগত ৪২ বছরে উভয় দেশের মধ্যে তিক্ততা যেমন ছিল তেমনই মধুর সম্পর্কের সময়ও ছিল। ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং ভারতীয় স্বার্থের মূল্যায়নে সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় ছিল ২০০৯ থেকে নিয়ে আজ অবধি। ১৯৭১ সালের সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে হবে, প্রকাশ করতে হবে এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ উপকার প্রদান করতে হবে- এটাই বাস্তব। কিন্তু কৃতজ্ঞতার সীমারেখা কতটুকু, অর্থাৎ কতটুকু পরিমাণ ভাষা প্রয়োগ, কতটুকু পরিমাণ উপকার প্রদান, কতটুকু পরিমাণ স্বার্থ-ত্যাগ করলে বলা হবে যে, বাংলাদেশ যথেষ্ট কৃতজ্ঞ- এই সীমারেখা কোনদিনই চিহ্নিত হয়নি। এই প্রসঙ্গটি আলোচনা করতে গেলেই, আলোচনাকারীকে রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত করে ফেলা হয়। বাংলাদেশ ভারতকে অনেক কিছুই দিলো। আরও অনেক কিছু দেয়ার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার মনে হয় প্রস্তুত এবং আগ্রহী। কিন্তু সময়ের অভাবে পেরে ওঠেনি। তাই আরও সময় চায়। মনে হচ্ছে যেন, বাংলাদেশ দিতেই থাকবে এবং ভারত নিতেই থাকবে, এ রকম একটি পরিস্থিতি।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির শেষাংশে, গুণ্ডে ছবির প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আমি একটি শব্দযুগল এখানে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি। ওই শব্দযুগল হচ্ছে: ‘ইলাস্টিসিটি অব গ্রাটিচিউড’- তথা কতটুকু কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে যথেষ্ট বলা হবে? ইলাস্টিক বস্তুকে যেমন বেশি টানলে ছিঁড়ে যায়, তেমনই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রক্রিয়াকে যদি টানতেই থাকে কেউ তাহলে সেটা ছিঁড়ে যেতে বাধ্য। আমার প্রশ্ন, আমরা কতটুকু টেনেছি? আমাদের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা আদায়ের নিমিত্তে বা কৃতজ্ঞতার উসিলায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র কি চায়? আমার অনুভূতি হচ্ছে যে, ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী এবং আঞ্চলিক পরাশক্তি। ভারতের সঙ্গে আমাদের গঠনমূলক বাস্তবতা ভিত্তিক সুসম্পর্ক রাখতেই হবে। পারস্পরিক আদান-প্রদানের মানদণ্ড স্থির করতেই হবে। এবং এই কাজটি করতে গেলে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ একটি বড় উপাত্ত হিসেবে কাজ করবে।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

ভারত- হায়দরাবাদ থেকে তেলেঙ্গানা by আলী ইমাম মজুমদার

প্রতিবেশী ভারতে শাসনকাজ সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য মাঝেমধ্যে বিভিন্ন রাজ্য ভাঙাগড়া হয়। এ ধরনের ভাঙাগড়ায় বিপরীতমুখী স্বার্থের সংঘাত থাকে বলে ব্যাপারটি কিন্তু সহজ নয়।
অতীতের ভাঙাগড়াগুলোও সহজে হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে ঘটেছে সংঘাত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিদের সুবিবেচনাপ্রসূত মতামতের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হয়েছে। ঠিক তেমনি দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশকে ভেঙে তেলেঙ্গানা নামের একটি রাজ্য গড়ার জোর দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। এটা নিয়ে দফায় দফায় আন্দোলন হয়েছে। প্রাণহানিও ঘটেছে বেশ কিছু মানুষের। ১৯৬৯ আর ১৯৭২-এ আন্দোলনের তীব্রতা ছিল প্রকট। কিন্তু তখন আলোর মুখ দেখেনি দাবিটি। তা দেখল ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ভারতের ২৯তম রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রায় সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে তেলেঙ্গানার। সম্প্রতি লোকসভা ও রাজ্যসভায়ও জনপ্রতিনিধিরা যখন এটা নিষ্পত্তি করেন, তখনো কিন্তু বিষয়টি সহজসাধ্য ছিল না। তবে প্রধান দুটো দল একমত হওয়ায় অন্যদের আপত্তি ধোপে টেকেনি।

ফেডারেল সরকারব্যবস্থায় এ ধরনের রাজ্য বিভক্তির পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকে। উভয় পক্ষ প্রায় ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান নেয়। তা সত্ত্বেও জনগণের বৃহত্তর কল্যাণ বিবেচনায় রেখে একপর্যায়ে একটা সমাধান করতে হয়। আর এটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। আবার এ ধরনের দাবি একটি মেনে নিলে সমধর্মী দাবিও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর কেন্দ্রীয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাজ্যও এ ধরনের দাবির পক্ষে ঢালাওভাবে অবস্থান নিতে পারে না। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর পর্যালোচনার পরই একেকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবু নিজ নিজ অবস্থানে থেকে অনেকে আন্দোলন চালায়। ভারতে গত বিজেপি সরকারের সময়ে তিনটি নতুন রাজ্য গঠিত হয়েছিল। সেগুলো হচ্ছে উত্তর প্রদেশ, ওডিশা আর বিহার ভেঙে যথাক্রমে উত্তরাঞ্চল, ছত্তিশগড় আর ঝাড়খন্ড। এখনো জোর দাবি চলছে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ, আসামের বোড়োল্যান্ড আর পশ্চিমবঙ্গের গুর্খাল্যান্ডসহ আরও কিছু অঞ্চলে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি রাজ্য গঠনের সময়ে তার ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ সব দিক বিবেচনা করতে হয়। পার হতে হয় জটিল সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
কতগুলো দিক বিবেচনায় তেলেঙ্গানাকে প্রকৃত অর্থে সম্পূর্ণ নতুন একটি রাজ্য বলা যাবে না। এ অঞ্চল মূলত ব্রিটিশ-ভারতে হায়দরাবাদ রাজ্যের অংশবিশেষ। ১৯৪৮ সালে এর ভারতভুক্তি হয়। এর আগে ইংরেজ শাসকেরা রাজ্যটির বেড়ার নামক একটি অংশ মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়। ভারতভুক্তির পরও মারাঠাভাষীর কিছু অংশ মহারাষ্ট্র আর কানাড়াভাষী কিছু অংশ কর্ণাটকের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তেলেগুভাষী অংশটিকে ১৯৫৬ সালের রাজ্য পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকালে অন্ধ্র প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সেই হায়দরাবাদ নগরই হয় অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী।
ভাষার সাযুজ্য থাকলেও এর একটি ঐতিহাসিক পৃথক সত্তা ছিল। ১৭২৪ সাল থেকে পৃথক দেশীয় রাজ্য হিসেবে এর শাসনভার ছিল নিজাম পরিবারের হাতে। সীমানার কিছু পরিবর্তন হলেও ব্রিটিশরা এ সত্তা বহাল রাখে। ব্রিটিশ-ভারতের ৫৫৬টি দেশীয় রাজ্যের মধ্যে এটি ছিল সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ। মূল হায়দরাবাদ রাজ্যের আয়তন ছিল দুই লাখ ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। কেটে নিয়ে অন্ধ্রের সঙ্গে যেটুকু দেওয়া হয়েছে, তার আয়তন এক লাখ ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। আর বর্তমান লোকসংখ্যা সাড়ে তিন কোটি। অবিভক্ত অন্ধ্র প্রদেশের আয়তন দুই লাখ ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার। আর লোকসংখ্যা সাড়ে আট কোটি। এর সরকারি ভাষা তেলেগু ও উর্দু। সুজলা-সুফলা এ রাজ্যকে ভারতের খাদ্যভান্ডার বলা হয়। চাল ছাড়াও চিনিসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য ও মৎস্য উৎপাদনে অগ্রণী এ অন্ধ্র প্রদেশ।
পাশাপাশি শিল্পায়নেও অনেক অগ্রসর। মাথাপিছু গড় আয়ের দিক দিয়ে ভারতে দ্বিতীয়। অন্ধ্রের রাজধানী হায়দরাবাদের আয়তন ৬৫০ বর্গকিলোমিটার। আর জনসংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। ভারতের চতুর্থ জনবহুল শহর। এ নগর রাজ্যের জিডিপি আর কর প্রদানে শীর্ষে রয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তথ্যানুসারে ভারতের নগরওয়ারি বিবেচনায় হায়দরাবাদ ব্যাংক আমানতে ষষ্ঠ আর ঋণ প্রদানে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এখানে রয়েছে প্রায় এক হাজার ৩০০টি উঁচু মানের আইটি ফার্ম। এর মধ্যে মাইক্রোসফটসহ বেশ কিছু নামজাদা বহুজাতিক কোম্পানিও আছে। অর্থাৎ ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে এ নগরে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুসারে, এটি ভারতের দ্বিতীয় ব্যবসাবান্ধব শহর। এর অর্থ ব্যাপক বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এখানে সুশাসনও স্বাভাবিক মাত্রায় রয়েছে। আগামী ১০ বছর নগরটি উভয় রাজ্যের যৌথ রাজধানী থাকবে বটে। এরপর চলে যাবে তেলেঙ্গানার ভাগে।
হায়দরাবাদ তেলেঙ্গানার রাজধানী হিসেবে পাবে। তবে উল্লেখ করা যথার্থ যে তেলেঙ্গানা নামক অঞ্চলটি অন্ধ্র প্রদেশের অন্য অঞ্চল থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। তাদের অভিযোগ রয়েছে সুষম উন্নয়ন না হওয়ার। যেকোনো কারণেই হোক এ অভিযোগের বাস্তবতা লক্ষণীয় হয়। যেমন গোটা অন্ধ্র প্রদেশের শাসনব্যবস্থায় তেলেঙ্গানাবাসীর সংখ্যা শতকরা ২০ জন। আর শীর্ষস্তরে এর অনুপাত শতকরা পাঁচজন। সুতরাং সূচনায় রাজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে তারা কিছু হোঁচট খাবে। তবে রাজনৈতিক দূরদর্শিতাসম্পন্ন নেতৃত্ব থাকলে নতুনভাবে গঠনের পর্যায়ে অঞ্চলনির্বিশেষে সবার সহযোগিতা নিতে নতুন সরকার সচেষ্ট থাকবে। নিজামের শাসনকাল থেকেই এ রাজ্যের অবকাঠামো উন্নত ছিল। ব্রিটিশের সাধারণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এর নিজস্ব সেনাবাহিনী, বিমান পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, রেলওয়ে, ডাক যোগাযোগব্যবস্থা, মুদ্রা ও বেতার সম্প্রচারব্যবস্থা ছিল। অর্থনীতিও পেছনে ছিল না। এখন মাঝখানে যেটুকু পিছিয়েছে, তা থেকে বিদ্যমান অবস্থায় দ্রুত উত্তরণ সম্ভব।
নতুন রাজ্য হিসেবে তেলেঙ্গানার এ অভ্যুদয়কে ভারতের রাজনৈতিক এমনকি সিভিল সমাজ নিরঙ্কুশভাবে স্বাগত জানাচ্ছে না। এখানে একটা তীব্র দ্বিধাবিভক্তি লক্ষণীয়। একটি অংশ এ ধরনের পুনর্গঠনের পক্ষে থাকলেও অপর অংশটি সক্রিয়ভাবে বিরুদ্ধে। যারা পক্ষে তারা বলছে একটি ভূখণ্ড তার পূর্ব সত্তা ফিরে পেলে নিজদের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ পাবে। সমৃদ্ধির গতি আরও বাড়বে। পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলো নজরে আসবে। ক্রমান্বয়ে অবসান ঘটবে তাদের পশ্চাৎপদতার। অপর অংশটির মতে, এ সিদ্ধান্ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়াবে। একের পর এক নতুন রাজ্য গঠনের দাবি আসতে থাকবে। তাঁরা আরও বলছেন, এ প্রবণতা ভারতকে ক্রমান্বয়ে ‘বলকানাইজেশন’-এর পথে নিতে পারে। এ ধরনের মতামত পোষণকারীদের মধ্যে কুলদীপ নায়ারের মতো প্রথিতযশা সাংবাদিকও রয়েছেন। উল্লেখ্য, ‘বলকানাইজেশন’ একটি ভূরাজনৈতিক শব্দ। একটি দেশ বা অঞ্চল পরস্পরের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত হওয়াকে ‘বলকানাইজেশন’ বলে অভিহিত করা হয়। এ শব্দটি মূলত ১৮১৭ থেকে ১৯১২ সময়কালে অটোমান সাম্রাজ্যের বলকান উপদ্বীপের অঙ্গরাজ্যগুলো বিভিন্ন রাজ্যের বিভক্তি থেকে নেওয়া হয়। ভারতের ক্ষেত্রে এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে অনেকে মনে করেন না। তাঁদের বিবেচনায় এখানে ফেডারেল সরকারব্যবস্থা থাকলেও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার, সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল, সুসংগঠিত সামরিক বাহিনী ও দক্ষ আমলাতন্ত্র রয়েছে। ব্যাপকভাবে না হলেও এ ধরনের দু-একটি ক্ষেত্রে নতুন রাজ্য গঠনকে প্রয়োজনীয় বিকেন্দ্রীকরণ বলে ইতিবাচক রূপে চিহ্নিত করছেন তাঁরা।
কেবল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা কোনো দেশের জন্য সুফল আনে না। শুরু থেকেই ভারত এ সত্য উপলব্ধি করে শক্তিশালী কেন্দ্রের অধীনেই কার্যকর রাজ্য প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। আর সময়ের প্রয়োজনে এসব রাজ্য নিয়ে কিছু ভাঙাগড়া চলতেই পারে। অন্ধ্র প্রদেশ ভাঙা নিয়ে দাবি দীর্ঘদিনের। কয়েক যুগ পর দাবিটি পূরণ হতে চলছে। কতিপয় ক্ষেত্রে সাময়িক অসুবিধা হলেও শেষাবধি তা কেটে যাবে বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। অন্য রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। আর একে নজির রেখে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবিও আসতে পারে। আসলেই সথেষ্ট যৌক্তিকতা না থাকলেও তা দেওয়া হবে এরূপ মনে করার কোনো কারণ নেই। সব আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে ভারতের ২৯তম রাজ্য তেলেঙ্গানা সুষম উন্নয়ন ও সংহতির পথে এগিয়ে যাবে—এটিই প্রত্যাশা।

আলী ইমাম মজুমদার
: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

সরল গরল- ছয় থেকে আট সপ্তাহের স্বাধীনতা by মিজানুর রহমান খান

২৫ ফেব্রুয়ারির দুপুর। সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের ১৬ নম্বর বিচারকক্ষের লাগোয়া বারান্দায় উপচে পড়া ভিড়। তাঁরা এসেছেন দূরদূরান্ত থেকে।
এক জায়গায় দেখলাম, পুরো একটি পরিবার বসে আছেন। জমি নিয়ে মারামারি। ঠাকুরগাঁও থেকে আগাম জামিন নিতে এসেছেন। প্রশ্ন হলো, তাঁরা গ্রাম থেকে কেন রাজধানীতে ছুটে এসেছেন? অধিকাংশ জামিনাদেশে লেখা আছে, ছয় থেকে আট সপ্তাহ পরে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিতে হবে এবং তখন জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালত স্বাধীন থাকবেন।
তার মানে সুপ্রিম কোর্ট স্বীকার করছেন এবং সুপ্রিম কোর্টের বাঘা বাঘা আইনজীবী, যাঁরা মুহূর্তে মক্কেলদের আগাম জামিনাদেশ পাইয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছেন, তাঁরাও স্বীকার করবেন, এখানে শুভংকরের ফাঁকি আছে। এক-এগারোর পর লাখ টাকা এমনকি কোটি টাকা ফিয়ের জামিনের গল্পও বাতাসে ভেসেছে। অত টাকা তো সাধারণ মানুষের নেই। গ্রামের মানুষেরা কি ঠকছেন? কতটা? আইনজীবীরা তাঁদের ত্রাতা?
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফের সঙ্গে কথা হলো। তাঁকে মিনিটে জামিনের সমর্থক আঁচ করি। বলি, সরকারে নেই তাই! বললেন, না আমি অ্যাটর্নি জেনারেল থাকতেও কখনো জামিনের বিরোধিতা করিনি। তবে কেন মানুষ হাইকোর্টে আসছেন, সেটা অনুসন্ধানযোগ্য বলে মনে করেন তিনি। মওদুদ আহমদ মিনিটে জামিনের বিষয়ে মন্তব্য করতে নারাজ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদালতের স্বাধীনতা দেখেন। বললেন, বঙ্গবন্ধুর আমলে আদালতের ওপর চাপ ছিল না। রক্ষীবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে বেআইনি ঘোষণা করে বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের দেওয়া মাইলফলক রায় স্মরণ করলেন। জামিনপ্রার্থীদের ভিড় প্রশ্নে, বিশেষ করে নিম্ন আদালতের ওপর সরকারের প্রচণ্ড চাপের ওপরই জোর দিলেন তিনি।
সরকার নিয়ন্ত্রণ করে তাই নিম্ন আদালতে মানুষ যদি জামিন নিতে না-ই যান, তাহলে সেই একই আদালত কী কারণে ছয় থেকে আট সপ্তাহ সময়ের পর স্বাধীনভাবে জামিন দিতে পারবেন? আট সপ্তাহের ব্যবধানে অভিযুক্তকে আবার নতুন করে ছোট আদালতের আইনজীবী ধরতে হবে। জামিনের দরখাস্ত করতে হবে। তাহলে লাভটা কী? এটাই ফাঁকি।
আমরা জানলাম, বড় আদালতের ছোঁয়াই কাফি। হাইকোর্ট যেহেতু জামিন দিয়েছেন, তাই নিম্ন আদালত ভরসা করতে পারেন। তাহলে কিন্তু আমজনতা বুঝবেন, ওটা আইনের শাসন নয়, মৃতসঞ্জীবনী সালসা। নিম্ন আদালতের বিচারকের বুকের ছাতি ফোলানোর বটিকা।
সুতরাং আইনবিদ ও আইনজীবীরা একে আগাম জামিন বলবেন। কিন্তু আমি বলব না। আসলে হাইকোর্টের অব্যাহত গণজামিন প্রমাণ করছে যে, বিচার বিভাগ পৃথক্করণ মুখ থুবড়ে পড়েছে। নিম্ন আদালত সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মুঠোবন্দী থাকতেও জামিনের এমন হিড়িক দেখা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালে দুই দিনে এক হাজার ২০০ জামিন নিয়ে মন্তব্য করে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর সেই উক্তি অসতর্ক ছিল মানি। কিন্তু ১৫ বছরের ব্যবধানে সেই রায়টি পড়ে মনে হলো, বড় মুখ নিয়ে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ সেদিন যেভাবে শেখ হাসিনার প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন, সেই বড় মুখ আজ অবশিষ্ট নেই। ওই রায়টি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
১৯৯৮ সালের ২৫ ও ২৬ আগস্ট দুই দিনে ১৫৫টি জামিন দিয়েছিলেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। শেখ হাসিনা তা ভুল করে এক হাজার ২০০ বলেছিলেন। সেদিন সংখ্যাগত ভ্রান্তিকেই বড় করে দেখা হয়েছিল, আদালত নিজেদের ওজস্বিতায় সংবেদনশীল ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার বক্তব্যের চেতনা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন, ‘ওই ঘটনা প্রধান বিচারপতিকে জানালে কেবল বেঞ্চ পরিবর্তন করেন, অন্য ব্যবস্থা নেননি, ব্যবস্থা নিলে জুডিশিয়ারি অনেক দায়দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেত এবং জুডিশিয়ারি সম্পর্কে মানুষের মনে কোনো সন্দেহ দেখা দিত না।’ আজও প্রাসঙ্গিক বলছি এ কারণে যে, ‘ওই ধরনের ঘটনা’ অব্যাহত আছে বরং আরও গুরুতরভাবে চলছে। শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালে প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলেছিলেন, যদি তদন্ত করা হতো, ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তবে জুডিশিয়ারি অনেক দায়দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেত। ২০০৯ সালে তদন্ত হলো। ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। জনমনের সন্দেহ ঘুচল না।
মিনিটে একটি আগাম জামিন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বললেন, ‘আমি গভীরভাবে হতাশ। কয়েকটি বেঞ্চে আইন কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহী। কারণ, তাঁরা রাষ্ট্রপক্ষে কথা বলার সুযোগ পান না।’
২০০৯ সালে যখন দুজন বিচারক ৩৮ সেকেন্ডে একটি আগাম জামিন দিলেন, তখনো কেবল সংশ্লিষ্ট বিচারকদের এখতিয়ার রহিত করা হয়েছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল নিশ্চিত জানালেন, জামিনাদেশের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে সুপ্রিম কোর্টের গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন হারিয়ে গেছে।
তাই বলছিলাম, শেখ হাসিনার ‘অতিরঞ্জিত’ উক্তি অপ্রাসঙ্গিক হয়নি। অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে আগের সরকারকে দায়ী করার বিষয়টি। ২০০৯ সালে ওই তদন্ত কমিটি দেখেছিল, এক দিনে কার্যতালিকায় এক হাজার ১৪২টি মামলা আদেশের জন্য ছাপা হয়েছিল। ১৩টি কার্যদিবসে এক হাজার ৩৭২টি আগাম জামিন এবং ৬৮৯টি অন্যান্য আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ওই বেঞ্চ এক দিনে সর্বোচ্চ ২৪৮টি আগাম জামিন দেন। আর এখন এক দিনে ৩০৭টি আগাম জামিনের আদেশ মিলেছে। তাহলে এটিও তদন্তের দাবি রাখে।
১৯৯৯ সালে আপিল বিভাগ বেশ গর্বের সঙ্গে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ‘হাইকোর্ট ব্যবস্থা সম্পর্কে যাঁদের জ্ঞান আছে, তাঁরাই জানেন দুই দিনে একটি বেঞ্চের এক হাজার ২০০ জামিন দেওয়া অবাস্তব। বিচারকেরা যদি ওই হারে মামলা নিষ্পত্তি করতেন, তাহলে তো মামলা জটই থাকত না।’ কিন্তু ১৯৯৯ সালে যা তাদের কথায় ‘ফিজিক্যালি ইম্পসিবল’ ছিল। তা ‘ফিজিক্যালি পসিবল’ হচ্ছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিবৃতি দাবি করি। কারণ, আপিল বিভাগ বলেছিলেন, সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে আগাম জামিন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর অসন্তোষ ব্যক্ত করার অধিকার আছে। আমরা মনে করি, এই অধিকার প্রয়োগের এখন উত্তম সময়। কারণ, একাধিক বেঞ্চে ‘বাছবিচারহীন আগাম জামিন’ চলছে।
আগাম জামিন নিয়ে আমাদের উচ্চ আদালতের দুটি টেস্টামেন্ট আছে। ওল্ড টেস্টামেন্ট লেখা হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ২৫ মে। আগাম জামিন নিয়ে শেখ হাসিনাকে ভর্ৎসনা করার ৮১ দিন পর। তখন প্রধান বিচারপতি এ টি এম আফজাল লিখেছিলেন, ‘আগাম জামিন দেবেন হাইকোর্ট। জেলা জজ ও দায়রা আদালত নন।’ রাষ্ট্র ঠিক উল্টো বলেছিল। সে কারণেও কি আগাম জামিন পেতে আজ জনস্রোত আছড়ে পড়ছে উচ্চ আদালতে? আপিল বিভাগ যদি রাষ্ট্রের সঙ্গে একমত হতেন, তাহলে শেখ হাসিনাকে তিরস্কার করে দেওয়া মার্চের রায় টেকে না। কারণ, শেখ হাসিনার উল্লিখিত হাইকোর্ট যে ৩৬৭ জন অভিযুক্তকে আগাম জামিন দিয়েছিলেন, তাঁরাও নিম্ন আদালত এড়িয়েছিলেন।
ওল্ড টেস্টামেন্টের সবই ভালো। এটুকু ছাড়া। আইন কিন্তু বলছে, আগাম জামিন ছোট-বড় উভয় কোর্ট দিতে পারেন।
মাহমুদুল ইসলাম ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘আগাম জামিন নিতে সরাসরি হাইকোর্টে আসা যাবে না। আগে জেলা ও দায়রা জজের কাছে যেতে হবে।’ অবশ্য এটাও শতভাগ গ্রহণযোগ্য নয়। তবে ওল্ড টেস্টামেন্টের একটা সংশোধনী লাগবে। কারণ, এতে নিম্ন আদালতকে খাটো করা আছে। বলা হয়েছে, আগাম জামিন দিতে তারা সাহস পাবেন না।
তবে ওল্ড টেস্টামেন্ট কিন্তু বাছবিচারহীন জামিনদানকে জুডিশিয়াল এক্সট্রাভ্যাগাঞ্জ বলেছিলেন। বাংলা একাডেমির অভিধানমতে এটা অসংযত বিচারিক আচরণ। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতকে নিজের শরীরের অংশ ভাবেনই না। আবার হাইকোর্টের স্বাধীনতাও যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। নিম্ন আদালতে সরকারের হস্তক্ষেপ বিবেচনায় মিনিটে মিনিটে জামিনদান এবং ৫৬১(ক) ধারার আওতায় নিম্ন আদালতের বিচার-প্রক্রিয়া বাছবিচারহীনভাবে স্থগিত করে দেওয়ার অনুশীলনকে আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা জ্ঞান করতে পারব না। নিম্ন আদালত, তুমি কার শরীরের অংশ—সরকারের, না সুপ্রিম কোর্টের? জামিন ও স্থগিতাদেশ (স্টে) প্রদানের চেতনা যে তেলে (সংবিধানগত) দাউ দাউ করে জ্বলে, সেই তেলে নিম্ন আদালতকে নির্বাহী বিভাগের রাহুমুক্ত করার সাংবিধানিক, আইনগত, সংবিধিবদ্ধ ও এমনকি আপিল বিভাগের রায়গত কর্তব্যবোধ টিম টিম করেও জ্বলে না।
একশ্রেণীর বেঞ্চ অফিসার দুর্নীতিগ্রস্ত। অ্যাটর্নি জেনারেল আমাকে আদালত প্রশাসনে ‘রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি’র কথা বলেছিলেন। তদুপরি অবাক হলাম। ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি বিচারকক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এক তরুণ আইনজীবী এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে কথায় কথায় ২০ হাজার টাকার একটি বান্ডেল বের করলেন। ঈষৎ মলিন নোটগুলো ৫০০ টাকার। এই অর্থ খরচ করে আগাম জামিনের দুটি আবেদন তিনি কার্যতালিকায় ছাপাতে চান।
জামিনপ্রতি আইনজীবীরা মাথাপিছু ১০ হাজার টাকা ফি নিলে সাড়ে ৫০০ আবেদনে এক হাজার লোক জামিন পেলে তাঁদের কেবল ফি খরচা দাঁড়ায় এক কোটি টাকা। এক হাজার মানুষের অনধিক আট সপ্তাহের স্বাধীনতার দাম এক কোটি টাকা। একে কি বলব না ঘোর অমাবস্যার ‘জামিনার্থনীতি’।
৬ জুন ২০১০ নিউ টেস্টামেন্ট লেখেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। আগে হাইকোর্ট নিম্ন আদালতকে জামিনবান্ধব নির্দেশনা দিতেন। এরপর সেটা বন্ধ হয়েছে। তবে উভয় টেস্টামেন্ট সংশোধনের দরকার আছে। নিউ টেস্টামেন্টে রুল দেওয়া বন্ধের নির্দেশনাটি গ্রহণযোগ্য নয়। বিধিবদ্ধ আইন করতে ওল্ড টেস্টামেন্টের নির্দেশনা আইন কমিশন এখনই বিবেচনায় নিতে পারে। বাছবিচারহীন আগাম জামিনের বিরুদ্ধে উভয় টেস্টামেন্টে অবশ্য কঠোর হুঁশিয়ারি আছে। হাইকোর্টের তা না মানা সংবিধান লঙ্ঘন। ২০০৯ সালের তদন্তের আলোকে ব্যবস্থা চাই। না পারলে অন্তত প্রতিবেদনের প্রকাশনা চাই। যেকোনো বাছবিচারহীন আগাম জামিনের তদন্তপূর্বক আশু প্রতিকার দাবি করি। (শেষ)


মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com